কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব, যেখানে ২০২৩ সালে প্রতিদিনের পণ্য ও সেবার লেনদেন দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ)। যুক্তরাষ্ট্রের মোট পণ্য বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ আসে কানাডা থেকে। কানাডার ৭৫ শতাংশ রপ্তানি পণ্য যায় যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিপক্ষীয় এ বাণিজ্যের মূল খাত অটোমোটিভ, জ্বালানি, কৃষি। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল আমদানির ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে কানাডা। দুই দেশের মধ্যে গাড়ির যন্ত্রাংশ সীমান্ত অতিক্রম করে একাধিকবার।
কিন্তু এ পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্কটি বাণিজ্যিক টানাপোড়েন থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, শিল্প পুনর্গঠন এবং বৈশ্বিক নীতির নতুন পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের টানাপোড়েন আরও ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ আমাদের চোখে আনে উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা। আবার একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্রদেশগুলোর মধ্যকার প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিস্থাপকতার দিকটিও স্পষ্ট করে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–বিরোধ ইস্যুটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর।
যদিও জনসমক্ষে আলোচনায় প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা প্রাধান্য পায়। তবু কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ইতিহাসে নানা বিরোধ দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে, যা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে সামনে আসেনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৯৬০-এর দশকের তথাকথিত ‘চিকেন ওয়ার’ এবং দীর্ঘস্থায়ী সফটউড লাম্বার নিয়ে বিরোধ। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল, অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ অর্থনৈতিক নীতির যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড এক্সপানশন অ্যাক্টের সেকশন ২৩২–এর আওতায় জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কানাডিয়ান ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেকশন ২৩২-এর আওতায় কানাডিয়ান ইস্পাতের ওপর ২৫ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নির্বাচিত পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এ পদক্ষেপগুলো বিদ্যমান সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করে এবং দুই দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ফলে উভয় দেশ সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।
চার দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এ বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—কানাডা তার সফটউড লাম্বার খাতকে ভর্তুকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার কানাডার ডেইরি, ডিম ও মুরগির জন্য চালু করা সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নীতিকে সমালোচনা করেছে এবং একে বাজারে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখিয়েছে। দুই দেশের এ টানাপোড়েনে দেখা দিয়েছে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামে দামের অস্থিতিশীলতা। সফটউড লাম্বারে শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শুধু ২০১৮ সালেই কানাডায় প্রায় ২৩ হাজার চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
একই প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রেও, বিশেষত কানাডিয়ান মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে। কাঠামোগত কারণ ও কৌশলগত স্বার্থ কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য–বিরোধের স্থায়িত্ব ও বিবর্তনকে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি ও উদীয়মান কারণে আকার দিচ্ছে।
যেমন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান। ২০১৬ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও শিল্প বিচ্ছিন্নকরণের (ইন্ডাস্ট্রি ডিকাপ্লিং) প্রবণতা জোরদার হয়েছে। ‘বাই আমেরিকান’ তথা ‘আমেরিকান পণ্য কেনো’ ধরনের নীতি উত্তর আমেরিকার সাপ্লাই চেইন সংহতকরণের মডেলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
ট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা
এসব ঘটনার পরও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো—যেমন জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট), ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এবং নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা), পরে যার পরিবর্তে আসে ইউনাইটেড স্টেটস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট (ইউএসএমসিএ)—দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে, যা কানাডার কোটার বণ্টন পদ্ধতির কিছু দিককে চুক্তির শর্তাবলির সঙ্গে অসংগত ঘোষণা করে এবং নীতি সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এতে কঠোরতর উৎস নিয়ম, একটি ‘সানসেট ক্লজ’ ও পুনর্গঠিত বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়। এসব পরিবর্তন নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারদের জন্য কৌশলগত পুনর্গঠন অপরিহার্য করে তোলে।
কিন্তু একাধিক বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়ায় আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায়নি; বরং জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কানাডিয়ান সফটউড লাম্বারের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং শুল্ক বজায় রাখে, যার গড় ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অস্থিরতার ঝুঁকির কারণে কানাডা রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে এবং পদ্ধতিগত ঝুঁকি হ্রাস করা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে সিপিটিপিপি এবং সিইটিএ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এশিয়া-প্যাসিফিক ও ইউরোপীয় অঞ্চলে বহুপক্ষীয়, বহুমুখী ও বহুখাতীয় চুক্তির আওতায় রপ্তানি বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্য–বিরোধের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত শিক্ষা পাওয়া যায়, যা অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য।
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একতরফা শুল্ক আরোপ ও বিরোধ নিষ্পত্তিপ্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা বাজার আস্থাকে ক্ষুণ্ন করে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলে।
কানাডার জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব জোরদার করা মানে হলো উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৌশলগত খাতে বিনিয়োগ করা এবং বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অভ্যন্তরীণ শিল্পনীতির প্রয়োজনীয়তা ও সমন্বিত মহাদেশীয় সাপ্লাই চেইন থেকে প্রাপ্ত দক্ষতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীল মিত্রদেশগুলোর মধ্যেও বাণিজ্যিক উত্তেজনা উদার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে। অভিযোজন, বিচক্ষণ নীতি ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এ সম্পর্কের স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য।
আগামী দিনে জলবায়ু-সম্পর্কিত বাণিজ্যনীতি, ডিজিটাল বাণিজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের ভূরাজনীতি বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভিযোজন ক্ষমতাকে পরীক্ষা করবে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন উভয়ের সরকারি বক্তব্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহযোগিতার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। যদিও দেশীয় ও বৈশ্বিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রায়ই অর্থনৈতিক সংহতির মডেল হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি নিয়মিত বিরোধ ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বিরোধ উত্তর আমেরিকার বাণিজ্যকাঠামোর শক্তি ও দুর্বলতা উভয়কেই স্পষ্ট করেছে। নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের জন্য এ অভিজ্ঞতা শিক্ষা দেয় যে এক অনিশ্চয়তার যুগে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, প্রমাণভিত্তিক নীতি এবং দূরদর্শী অর্থনৈতিক কূটনীতি অপরিহার্য।

